মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৪৯ অপরাহ্ন

শিরোনাম :
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে আইন মন্ত্রী আনিসুল হক বে-সরকারি ভাবে নির্বাচিত কসবায় ভোট দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ আহত-৪ কসবায় এলজিইডি’র শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান আগরতলায় স্রোত আয়োজিত লোকসংস্কৃতি উৎসব কসবা প্রেসক্লাব সভাপতি’র উপর হামলার প্রতিবাদে মানবন্ধন ও প্রতিবাদ সভা কসবায় চকচন্দ্রপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক ফলাফল ঘোষণা, পুরস্কার বিতরণ ও ছবক প্রদান শ্রী অরবিন্দ কলেজের প্রথম নবীনবরণ অনুষ্ঠান আজ বছরের দীর্ঘতম রাত, আকাশে থাকবে চাঁদ বিএনপি-জামাত বিদেশীদের সাথে আঁতাত করেছে-কসবায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ১৩ দিনের জন্য ভোটের মাঠে নামছে সশস্ত্র বাহিনী
হারিয়ে যাচ্ছে পাখপাখালি

হারিয়ে যাচ্ছে পাখপাখালি

দীপক সাহা
কলকাতা

শেষ আশ্রয়টাও গেল ! তালগাছ, নারকেল গাছের অভাবে বাবুই পাখি ইলেক্ট্রিক তারে বাসা তৈরি করতে বাধ্য হচ্ছে। সেখানেও নিস্তার নেই। বিদ্যুৎ দফতরের লোকজন তারে ঝুলে থাকা বাবুইয়ের বাসাগুলি ভেঙে দিয়েছেন। নষ্টনীড়ের অবলা ছোট্ট পাখিগুলো দিশেহারা, শোকে মুহ্যমান। মানব সভ্যতার হুমকিতে হারিয়ে যাচ্ছে তালের পাতায় মোড়ানো নিপুন কারুকার্য খচিত বাবুই পাখির বাসা। সেদিন খবরের কাগজের পাতায় এক কোণে খবরটি পড়ে মনটা কেমন করে উঠলো।

এক সময়ে নদী-নালা-খাল-বিল, গাছ-গাছালি, পাক-পাকালিতে সমৃদ্ধ গ্রাম বাংলা এখন পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে না, পাখির ডাকে জেগেও ওঠে না। গ্রামের মানুষের আর ভোরবেলায় মোরগের উচ্চ কণ্ঠস্বরে ঘুম ভাঙে না। এখন ঘুম ভাঙে মোবাইলের রিং টোনে অথবা গাড়ির যান্ত্রিক শব্দে। সকল দেশের রানী বঙ্গভূমিতে আর দোয়েল পাখির মিষ্টি মধুর ডাক শোনা যায় না , ফিঙে পাখিকেও গাছের ডালে বসে ঝুল খেলতে দেখা যায় না। বক, পানকৌড়ি, বেলে-হাঁস, চকাচকি, মাছরাঙা, গাঙ শালিখের ঝিল-বিলে জলকেলি শুধু টিভি , সিনেমার পর্দায়। নিঝুম গ্রীষ্ম-দুপুরে চাতক পাখির ‘ ফটিক জলে ‘র কাতর প্রার্থনা কিংবা নিস্তব্ধ বাড়ির উঠোনে ঘুঘুর একটানা ‘ ঘু…..ঘু ‘ মন আনমনা করা ডাক কই ! বাড়ির ঘুলঘুলির চড়ুই পাখি কোথায় হারিয়ে গেছে। গাছের ডালে ডালে পাখির কলকাকলিতে সবসময় মাতোয়ারা থাকতো গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি। নিশাচর বাদুড়, পেঁচা এখন দুর্লভ। দূষণের ছোবলে শহরের পার্কগুলিও প্রায় পাখিশূন্য। একমাত্র ‘ ঝাড়ুদার ‘ কাকের শহরে অবাধ বিচরণ। সবুজের সাথে সাথে বাংলার প্রকৃতি থেকে ক্রমশ উধাও হচ্ছে বসন্ত বৌরি, নীলকণ্ঠ পাখি, বউ-কথা-কও প্রভৃতি বিভিন্ন প্রজাতির রঙ-বেরঙের পাখি।

মানুষের অত্যাচারে খাল-বিল, জলাভূমি, নদীনালা শুকিয়ে যাচ্ছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে পুকুর, দিঘি। এসব জলাভূমি হচ্ছে পাখির বেঁচে থাকার রসদ। সভ্যতার অগ্রগতির অজুহাতে নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। গ্রামের স্বাভাবিক গাছগুলো পাখিদের আবাসস্থল ও নিরাপদ খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে। পরিবারের গর্বের আম-কাঁঠাল-লিচু-জাম-পেয়ারার বাগান আর কেউ রাখছেন না। ফলে নিশ্চুপ পাখির কিচিরমিচির। স্বাভাবিক ফলের গাছ ধ্বংস হওয়ার ফলে পাখির খাদ্যে আকাল পড়ছে। পাখির আবাসস্থল নির্বিচারে ধ্বংস ও বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের বিরূপ প্রভাবে পাখি আজ বিলুপ্তপ্রায়। শ্যামা, দোয়েল, ঘুঘু, বাবুই, মাছরাঙা, টুনটুনি, শালিক, চড়ুই, কোকিল, কাঠঠোকরা, ডাহুক, চিল, শকুন সহ আরো অনেক পাখি আর সচরাচর দেখা যায় না। দর্জিপাখি টুনটুনির দেখা মেলা ভার। উন্মুক্ত নীলাকাশে উড়ন্ত টিয়াপাখির ঝাঁক কবে দেখেছি মনে করা দুষ্কর। এখন আর পূবের মাঠ ছাড়িয়ে বকের পাখায় আলোক লুকোয় না। পাকুড়, বট গাছে ঝুলন্ত বাদুড়ের বিচিত্র কোলাহল হারিয়ে গেছে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে পেঁচার তীক্ষ্ণস্বর বাচ্চার ঘুম ভাঙায় না। দূষণের কবলে ছন্নছাড়া বসন্তে কোকিলের কুহুতান গাছের আড়াল থেকে আর ভেসে আসে না। জীবনানন্দের গ্রামে আজ শঙ্খচিল, গাঙচিলের আনাগোনা বন্ধ। গ্রামে চলছে নগরায়নের সবুজ নিধন যজ্ঞ। আর সেই নিধন যজ্ঞে ঝাঁকে ঝাঁকে আহুতি দিচ্ছে গ্রাম বাংলার বৈচিত্র্যময় পাখি ।

বর্তমান প্রজন্মের কাছে এসব পাখি হয়ে যাচ্ছে গল্প আর ইতিহাস। এমনকী পাখিকে ছবি অথবা বই দেখে চিনতে হয় শিশু-কিশোরদের। কার্টুনের সাহায্যে পাখির পরিচয় হচ্ছে বাচ্চাদের। এ প্রজন্মের অনেক শিশু-কিশোর কখনও দেখেনি মুক্ত আকাশে উড়ন্ত পাখির ঢল , শোনেনি এসব পাখির কলতান।

দেশের স্থানীয় পাখি ছাড়াও শীতকালে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে বাংলায় আশ্রয় ও খাবারের জন্য আসে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। যাদের আমরা বলি অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখি । এই পাখিগুলোর কল-কাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল। এরা সাধারণত আশ্রয় নেয় জলাভূমি, বিল, পুকুর, নদী তীরবর্তী জায়গায়। পরিযায়ী পাখির উদ্দাম উপস্থিতিতে এসব জায়গার সৌন্দর্য বেড়ে যায় কয়েকগুণ। কৌতূহলী মানুষ ভিড় করে এদের দেখতে। কিছু অসাধু চক্র পরিযায়ী পাখিগুলোকে বিক্রির উদ্দেশে অবৈধভাবে শিকার করে। সামান্য লাভের জন্য আমাদের জীববৈচিত্র্যের যে কত বড় ক্ষতি হচ্ছে এই বোধোদয় এসব অসাধু মানুষের ভেতর নেই।

প্রযুক্তির অতি দ্রুত অগ্রগতির ফলে জলবায়ু দারুণভাবে বিঘ্নিত। ফলে খাপ খাওয়াতে পারছে না পশুপাখিরা। তারা হারিয়ে ফেলছে অভিযোজনের ক্ষমতাই। ফলে বাড়ছে তাদের অবলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা। গ্রামগুলোতে আছড়ে পড়েছে আধুনিক যন্ত্রের ঢেউ। সেই ঢেউ-এ হাল ও গরুর এখন বেহাল দশা। মাথাল মাথায় কৃষক এক হাতে লাঙ্গল , অন্য হাতে লাঠি ; মাটি ফাটিয়ে লাঙ্গল টানছে দুটি বলদ গরু। কৃষক মুখে অদ্ভুত শব্দ করছেন আর মাঝেমধ্যেই লাঠির টোকা পড়ছে গরুর পিঠে। আর পেছনে পেছনে পাখির সারি, লাঙ্গলের ধাক্কায় মাটি থেকে বেরিয়ে আসা পোকমাকড়ের খোঁজে । এ-দৃশ্য এখন বিরল। কয়েক দশক আগে পাখি তাড়ানোর জন্য ফসলের জমিতে ‘ কাকতাড়ুয়া ‘ পাহারাদারের কাজ করতো। এখন আর বুলবুলিতে ধান খেতে আসে না। তাই মাঠে কাকতাড়ুয়ার প্রয়োজন শেষ। জমিতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কীটনাশক ও সার প্রয়োগের ফলে ফড়িং, প্রজাপতি, মশা, নানা জাতের পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ এখন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে পাখির খাদ্যাভাব। বিষাক্ত কীটনাশকযুক্ত শস্যদানা খেয়েও পাখির দল মারা যাচ্ছে নির্বিচারে। মাংসের লোভে শৌখিন শিকারীদের দৌরত্ম্যে শামকুল, ডাহুক, হরিয়াল আজ নিশ্চিহ্ন। মজে যাওয়া জলাশয়ে আর এই সব পাখির দেখা মেলে না।

রূপসী বঙ্গভূমির রূপ-সৌন্দর্যের অন্যতম অঙ্গ এইসব পাখি। বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজ এমনকি অর্থনীতির সঙ্গেও পাখিদের সুমধুর সম্পর্ক সুদীর্ঘ বছরের। বাস্তুতন্ত্রে প্রতিটি পশুপাখিরই বিশেষ ভূমিকা আছে। পাখিকে রক্ষার জন্য জনসচেতনতার পাশাপাশি পাখি শিকার রোধে আইনের প্রয়োগ এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিবিধান করতে হবে। জীববৈচিত্র্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলার আগেই পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে হবে। পাখিদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে ধীরে ধীরে একসময় আমাদের সুপরিচিত পাখিগুলো এদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। তার প্রভাব বাস্তুতন্ত্রে পড়তে বাধ্য।

শুধু পাখি প্রেমীরাই নয়, সময় হয়েছে আমাদের সকলের এগিয়ে আসার। আমরা সবাই মিলে যদি সচেতন হই, কাজ করি, নিজেদের ভুলগুলো শুধরে নিই – তবে একদিন নিশ্চয়ই পরিস্থিতি পালটে যাবে। আবার পাখিদের কলকাকলিতে ভরে উঠবে গ্রাম বাংলা নির্মল প্রকৃতি। খাঁচায় নয়, মুক্ত আকাশেই উড়ে বেড়াবে তারা।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD